সিনথেটিক এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের ফলে প্রাণীদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।শুধু তাই নয়, এসকল ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত আমিষ অর্থাৎ মাংস, দুধ ও ডিম খাবার ফলে মানুষের মধ্যেও ক্ষতিকারক রেসিডিউয়াল ইফেক্ট লক্ষ্য করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসসহ দেখা দেয় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
পশুসম্পদ মাংস, দুধ ও ডিমের মাধ্যমে মানুষের অন্যতম পুষ্টি উপাদান হিসেবে প্রাণীজ আমিষ সরবরাহ করে থাকে।পৃথিবীর দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানী এবং পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গবাদিপশু দ্রুত মোটাতাজাকরণের লক্ষ্যে আশির দশকে শুরু করেছিল গ্রোথ প্রোমোটার বা গ্রোথ হরমনের ব্যবহার। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় এসকল গ্রোথ প্রোমোটারের ক্ষতিকারক দিক সম্বন্ধে মানুষ অবহিত হয়। গ্রোথ প্রোমোটার পশুর দেহে ব্যাক্টেরিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধিসহ নানাভাবে পশুর মেটাবলিজমের বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে।কিন্তু এসকল সিনথেটিক এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের ফলে প্রাণীদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। শুধু তাই নয়, এসকল ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পশুর মাংস, দুধ ও ডিম খাবার ফলে মানুষের মধ্যেও ক্ষতিকারক রেসিডিউয়াল ইফেক্ট লক্ষ্য করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসসহ দেখা দেয় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এ কারণে ৯০ এর মাঝামাঝি থেকে পশুখাদ্যে এ সকল ওষুধের ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।অধিকন্তু, ২০০৬ এর ১ জানুয়ারি থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পশুখাদ্যে গ্রোথ প্রোমোটারের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে পশু উপাদান, মাংস, দুধ এবং ডিমের উৎপাদন হ্রাস পায়। কিন্তু পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার জন্য প্রাণীজ আমিষের চাহিদা বাড়তে থাকে। এই বাড়তি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞানীসহ পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং কৃষক হন্যে হয়ে ওঠে সিনথেটিক গ্রোথ প্রোমোটারের বিকল্প পশুখাদ্য উদ্ভাবনের নেশায়।
ন্যাচারাল হার্বস এর ব্যবহারের ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো। ন্যাচারাল হার্বস হতে পারে স্বাস্থ্যপ্রদ, নিরাপদ মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনের বিকল্প মাধ্যম। ন্যাচারাল হার্বস ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রিন গ্রোথ প্রোমোটার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্ল্যানটেইন একটি বহুবর্ষজীবি ঘাস জাতীয় হার্বাল প্ল্যান্ট যার বৈজ্ঞানিক নাম চষধহঃধমড় ষধহপবড়ষধঃধ। যে কোন ধরনের মাটিতে জন্মায় এবং খরা ও প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে। এটি ৮ থেকে ২৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাল জন্মায়। উচ্চতা ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয় এবং হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ক্ষমতা ৪ থেকে ৭ টন।ট্র্যাডিশনাল হিউম্যান মেডিসিন হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকা এবং চীনে এই হারবাল প্ল্যান্টের ব্যবহারের রয়েছে শত শত বছরের পুরানো ইতিহাস। মানবদেহে সর্দি, কাশি, ঘা, উচ্চরক্তচাপসহ ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধিতেও রয়েছে এর কার্যকারিতা। আমি জাপান সরকারের বৃত্তির আওতায় জাপানের ইউয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল থেকে এই হার্বাল ঘাসের গুণাগুণ এবং পশুর দেহে এর কার্যকারিতার উপর বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছি। সাধারণ ঘাসের তুলনায় এর মধ্যে অধিক পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ এবং ‘ই’ আছে। এ ছাড়া এর মধ্যে এমন কিছু বায়োএ্যাকটিভ কম্পোনেন্ট আছে যা সাধারণ ঘাসের নেই। এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবেও এর রয়েছে চমৎকার কার্যক্ষমতা। এসকল বৈশিষ্ট্যাবলী সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার পর আমি শুরু করি গবাদিপশুর দেহে এর উপকারিতা বিষয়ক গবেষণা। কার্বন এবং হাইড্রোজেনের স্টেবল আইসোটপ ডাইলিউশনের মাধ্যমে পশুর প্লাজমা লেভেলে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের মেটাবলিজম নিয়ে গবেষণা করা হয়। এতে আমরা
এই ঘাস খাওয়ানোর ফলে গবাদিপশুর দেহের কোষের মধ্যে প্রোটিনের সিনথেসিসকে বাড়িয়ে দেয় আর এই বৃদ্ধির হার অধিক তাপমাত্রা বা হিট স্ট্রেস এ আরো ভাল হয়। অর্থাৎ, আমাদের মত উষ্ণ অঞ্চলে অধিক তাপমাত্রায় পশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অনেকাংশে লাঘব হয়।কিন্তু এই প্ল্যানটেইন উষ্ণ তাপমাত্রাতেও হিট স্ট্রেসকে অনেকাংশে লাঘব করে। গবাদিপশুর শক্তির অন্যতম উৎস ভোলাটাইল ফেটিএসিড এবং গ্লুকোজের মেটাবলিজমেও রয়েছে উপকারী প্রভাব। এছাড়া গবাদিপশুর দেহ থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণও কমিয়ে দেয়। তাই গ্রিন হাউজ ইফেক্ট বা গ্লোবাল ওয়ারমিংয়েও রয়েছে এর অত্যন্ত উপকারী প্রভাব। মানবদেহে এই হারবাল প্ল্যান্টের রয়েছে কৃমিনাশক, বেদনানাশক, উচ্চরক্তচাপনাশক এবং এন্টি ক্যান্সারসহ বিভিন্ন শুভ দিক। অধিকন্তু প্রাণীদেহের সেল বা কোষ ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা করে। তাই এই প্ল্যানটেইন বর্তমানে ইউরোপীয় দেশগুলোতে গ্রিন টি (চা) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাপানের মত উন্নত দেশেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে গ্রিন টি এবং লজেন্সের উপকরণ হিসেবে। এই হার্বস শুধু পশুর উৎপাদন বৃদ্ধিই নয় বরং পশু উপাদান সংরক্ষণে এবং মাংসের গুণাগুণ অর্থাৎ লাল টকটকে রং, ফ্লেভার এবং চর্বির গুণগতমান বৃদ্ধিতেও সহায়তা করবে। মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের সর্বত্রই মানুষ ঝুঁকে পড়ছে অর্গানিক প্রোডাক্টের দিকে। তাইতো ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদিত পশু উপাদানের (মাংস, দুধ, ডিম) চেয়ে অর্গানিক অর্থাৎ হারবাল খাদ্য খাইয়ে উৎপাদিত পশু উপাদান ক্ষেত্রবিশেষে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সচেতন মানুষ এখন খাদ্যের গুণগতমানের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
উন্নত বিশ্বের চিত্র যখন এই তখন আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে প্রয়োজনীয় মাংস, দুধ ও ডিমের যোগান দিতে। আমাদের কাছে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটি অর্থাৎ গুণাগুণের চেয়ে পরিমাণটাই মূখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গ্রোথ প্রোমোটারের ব্যবহারের তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তাই সাধারণ মানুষ এর ক্ষতিকর দিক সহজেই অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু এর রয়েছে সাইলেনট লিথাল স্ট্রেথ বা ধীর প্রতিক্রিয়া। এজন্য এখনই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে সাধারণ মানুষের মাঝে। আমাদের দেশে গবাদিপশুর খাদ্য বা এনিম্যাল ফিডের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।আমাদের উচিত গবাদিপশুর সবুজ ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্বে প্রায় তিন দশক গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের পর এর ক্ষতিকর দিক অনুধাবন করে এখন বন্ধ করেছে এর ব্যবহার এবং একই সাথে বৃদ্ধি করছে পশুখাদ্যে ন্যাচারাল হার্বস এর ব্যবহার।
আমাদের সবুজ ঘাসেরই ঘাটতি পূরণে সবুজ ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা দরকার। মনে রাখতে হবে নিরাপদ আমিষের জন্য নিরাপদ পশুখাদ্য দরকার।
আমাদের দেশে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্যের প্রতি সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্নভাবে প্রচার প্রচারণা করা হচ্ছে। তবে মায়ের জন্য নিরাপদ খাদ্য (মাংস, দুধ ও ডিম) নিশ্চিত করা না হলে শুধু মায়ের স্বাস্থ্যই নয় নবজাতক শিশুসহ সবার স্বাস্থ্যেই পড়বে মারাত্মক প্রভাব।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS